বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে চিংড়ি ও মাছ দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত হিসেবে স্থান দখল করেছে। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে মোট মাছ উৎপাদন হয়েছে ৩৮.৭৮ লাখ মে. টন, যার বাজার মূল্য প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। একই অর্থ বছরে দেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে ১,৮৬,৬০৫ মে. টন চিংড়ি উৎপাদিত হয়েছে যার মধ্যে ১,৩২,৭৩০ মে. টন চাষকৃত চিংড়ি। খুলনা অঞ্চলে নিচু ধানক্ষেতের চারদিকে খনন করে বাঁধ বা ঘেরা দিয়ে ঘের তৈরি করা হয়, যেখানে জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ধান চাষ হয় এবং জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সনাতন বা উন্নত সনাতন পদ্ধতিতে গলদা চিংড়ির সাথে বিভিন্ন কার্প জাতীয় মাছের চাষ হয়। কার্প ও চিংড়ি মাছের বাণিজ্যিক গুরুত্ব থাকায় এসব মাছ প্রধানত অর্থ উপার্জনের জন্য বিক্রয় করা হয়। এর ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে চাষি পরিবারের মাছ খাওয়ার বিষয়টি উপেক্ষিত থাকে। গৃহস্থলির আমিষের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজি ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও AquaFish Innovation Lab-USAID এর যৌথ উদ্যোগে একটি গবেষণা প্রকল্প পরিচালনা করা হয়, যেখানে চিংড়ি ও কার্পের ঘেরে মলা মাছ (SIS) এবং পাড়ে মৌসুমি সবজি চাষ করা হয়।
মলা মাছের পরিচিতি
মলা (Amblypharyngodon mola) একটি দেশীয় প্রজাতির (SIS) ছোট মাছ। মলা মাছ সাধারণত ডিম থেকে ফোঁটার ৪৫-৬০ দিনের মধ্যে ৩-৬ গ্রাম ওজন বা ৬-৮ সেমি. লম্বা হলে খাওয়ার উপযোগী হয়ে থাকে। তবে অঞ্চল ভেদে এ মাছ ছোট বা বড় আকারের হতে পারে। এটি স্বাদুু পানির মাছ এবং সাধারণত নদী-নালা, খাল, বিল, পুকুর ও ছোট জলাশয় এমনকি নিচু ধান ক্ষেতে এদের প্রাচুর্য লক্ষ্য করা যায়। মৌসুমি বৃষ্টিপাতের সময় (জুন থেকে সেপ্টেম্বর) মলা মাছের উপযুক্ত প্রজনন মৌসুম। তবে এ মাছ সারা বছরব্যাপী কম বেশি প্রজনন করে থাকে। জন্মের ২.৫-৩ মাস পর মলামাছ প্রজননক্ষম হয় এবং এরা পুকুর, ঘের ও যে কোনো জলাশয়ে ডিম দিয়ে থাকে। এ মাছের কাঁটা নরম হওয়ায় মাথা ও কাঁটাসহ সম্পূর্ণ মাছটি শিশুসহ সব বয়সের মানুষ খেতে পারে। এ মাছ অত্যন্ত পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ এবং এতে বিদ্যমান প্রোটিন, চর্বি, ভিটামিন-এ, ক্যালসিয়াম, জিংক ও আয়রন শরীরের পুষ্টি চাহিদা পূরণে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। দিনদিন পরিবেশ বিপর্যয় ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণে প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছটির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এঅবস্থায় এ পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ মাছটির চাষের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম হয়ে পড়েছে।
চিংড়ি ঘেরে মলা চাষের গুরুত্ব
মলা মাছ সাধারণত পানির ওপরের স্তরের খাবার খেয়ে থাকে। এদের খাদ্য তালিকায় বিভিন্ন প্রাকৃতিক খাবার যেমন, উদ্ভিজ্জকণা, প্রাণিজ্জকণা, প্রোটোজোয়ান ও ছোট ক্রাস্টাসিয়ান লার্ভি, ডিম এবং দ্রবীভূত জৈবিক কণার আধিক্য দেখা যায়। চিংড়ি ও মলা মাছ ভিন্ন স্তরের খাদক, এবং এদের খাবারের ধরন ভিন্ন হওয়ায় খাদ্যের প্রতিযোগিতা হয় না। উপরন্তু চিংড়ির জন্য প্রয়োগকৃত খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ এবং প্রয়োজনাতিরিক্ত প্রাকৃতিক খাবার খেয়ে মলা মাছ জলজ পরিবেশকে ভালো রাখে।
চিংড়ি-কার্প-মলার মিশ্রচাষ
সনাতন বা উন্নত সনাতন পদ্ধতিতে ঘেরে চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে প্রতি হেক্টরে সাধারণত ১০,০০০-২০,০০০টি চিংড়ি ও ৫০০-১,০০০টি কার্প জাতীয় মাছ মজুদ করা হয় এবং সপ্তাহে ১-৩ দিন অনিয়মিতভাবে খাবার দেয়া হয়। ঘেরে গলদার মজুদ ঘনত্ব, খাদ্য প্রয়োগ, পানির গভীরতা ও ব্যবস্থাপনার তারতম্যের কারণে প্রতি হেক্টরে ৩৫০-৬০০ কেজি গলদা উৎপন্ন হয়ে থাকে।
এ গবেষণায় প্রতি হেক্টরে ২০,০০০টি চিংড়ির জুভেনাইল, ১,০০০টি আঙুলে রুই, এবং ২০,০০০টি ব্রুড মলা মজুদ করা হয়, এবং সপ্তাহে ৩ দিন খাদ্য প্রয়োগ করা হয়। ঘেরে প্রাকৃতিক খাবার বাড়ানোর জন্য প্রতি মাসে হেক্টরপ্রতি ১২-১৫ কেজি চিটাগুর ও ১৫০-২০০ গ্রাম ইষ্ট ২৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে ঘেরে প্রয়োগ করা হয়। পাশাপশি ১৫-২০ কেজি ইউরিয়া ও ৮-১০ কেজি টিএসপি সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। এতে ঘেরে মলাসহ অন্যান্য মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। উল্লেখ্য, গলদা ঘেরে মলা চাষের জন্য খাবার ও ব্যবস্থাপনা বাবদ অতিরিক্ত শ্রম ও অর্থ ব্যয় হয় না। গবেষণায় দেখা গেছে, ঘেরে গলদা-কার্পের সাথে মলা মাছ চাষ করলে উৎপাদনের ক্ষতি হয় না। ওই গবেষণায় সনাতন পদ্ধতিতে ঘেরে ৬ মাস চাষ করে হেক্টরপ্রতি ৫০৮.৮ কেজি গলদা ও ৬৩৩ কেজি রুই মাছের পাশাপাশি ৪৪০ কেজি অতিরিক্ত মলা মাছ উৎপাদিত হয়েছে। চাষকালীন প্রতিটি পরিবার প্রায় ৫০-৬০ কেজি মলা মাছ খাবার জন্য নিয়মিত আহরণ করেছে। মলামাছের গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এ মাছ ছাড়ার ১ মাস পর থেকে প্রয়োজন মতো আহরণ করে চাষিদের পারিবারিক আমিষ, প্রয়োজনীয় খনিজ ও ভিটামিনের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। এ মাছে ভিটামিন-এ, আয়রন, জিংক, ও ক্যালসিয়াম এর প্রাচুর্যতা থাকায় রাতকানা, ও রক্তশূন্যতা, ত্বকের ক্ষত এবং রিকেট্স রোগের প্রতিরোধক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
চিংড়ি ঘেরে সবজি চাষ
মাছ চাষের পাশাপাশি ঘেরের পাড়ে বিভিন্ন ধরনের মৌসুমি সবজি যেমন-লাউ, কুমড়া, শিম, বরবটি, ঢেঁড়স, কলা, ফুলকপি, শালগম, বাঁধাকপি, করলা, চিচিঙ্গা, পুঁইশাক, পালংশাক ইত্যাদি চাষ করা যায়। যার মাধ্যমে দৈনন্দিন পুষ্টি চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিক্রয় করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায়।
ঘেরে ধান, মাছ ও সবজির পুষ্টিচক্র
ধান গাছের অবশিষ্টাংশ এবং সবজির উচ্ছিষ্ঠাংশ পচনের ফলে জৈব পদার্থ এবং নাইট্রোজেন ও ফসফরাস জাতীয় যৌগ উৎপন্ন হয় যা ঘেরে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখে। মাছের খাবারের উচ্ছিষ্ঠাংশ ও মলমূত্র তলদেশে জমা হয়। তলদেশের জৈব উপাদান সমৃদ্ধ মাটি ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব ধান ও সবজি চাষ করে উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।
চিংড়ি ঘেরে মলা মাছ ও সবজির সমনি¦ত চাষের মাধ্যমে প্রান্তিক চাষিরা পরিবারের পুষ্টির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে। চিংড়ি ঘেরে মলা ছাড়াও অন্যান্য ছোট মাছ ও সবজির সমনি¦ত চাষের ফলে খাদ্য স্তরের সঠিক ব্যবহার সম্ভব হয়, ফলে জলজ পরিবেশ ভালো থাকে এবং চিংড়ি ও কার্প মাছের উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়। গবেষকবৃন্দ এ গবেষণায় আর্থিক সহায়তার জন্য AquaFish Innovation Lab-USAID এর নিকট কৃতজ্ঞ।
খন্দকার আনিছুল হক* শিকদার সাইফুল ইসলাম**
জয়ন্ত বীর** ওয়াসিম সাব্বির**
*প্রফেসর **সহকারী অধ্যাপক, ফিশারিজ এন্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজি ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা